অফিসে প্রবেশ করেই দেখা যায় যে যার মতো ফাইলপত্র ও বিভিন্ন কাগজপত্রে সিল মারায় ব্যস্ত। ভাবসাবে তাদের কর্মকর্তা মনে হলেও আসল পরিচয় হচ্ছে ওরা ‘দালাল’। চাকরি ছাড়াই রীতিমতো চেয়ার টেবিলে অফিস করছেন তারা। বাস্তবে এসব দালালরাই নিয়ন্ত্রণ করছেন বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) কুষ্টিয়া কার্যালয়। দালাল দিয়েই কাজ করতে হয় এটাই যেন নিয়ম বলে মেনে নিয়েছে গ্রাহকরা। দালালরা মাকড়সার জ¦ালের মত ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। সেই জ¦াল ভেদ করে কেউ অফিসের মূল কর্মকর্তার কাছে ভীড়তে পারেন না।
এতে ভোগান্তি পোহাচ্ছেন হাজার হাজার গ্রাহক। বাড়তি অর্থ গুনতে হচ্ছে তাদের। এতে সরকার নয়, লাভবান হচ্ছেন দালাল আর কর্মকর্তারা।
বিআরটিএ’র কুষ্টিয়া কার্যালয়ের কর্মচারীদের বিরুদ্ধে ঘুষ গ্রহণেরও অভিযোগ উঠেছে। ইন্সপেক্টরের সহকারি রাকিব এর বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি অভিযোগ। এক হাতে তিনি নিয়ন্ত্রন করেন ঘুষ বানিজ্য, দালাল, সবই। তাদের চাহিদা অনুযায়ী টাকা পরিশোধ না করলেই গ্রাহকদের হয়রানি করা হয়। এতে বিআরটিএ কার্যালয়ে সেবা নিতে গেলে চরম ভোগান্তি পোহাতে হয়। এখানে ঘুষ আর দালাল ছাড়া কোনো কাজই হয় না বলে অভিযোগ গ্রাহকদের। অভিযোগ আছে, ঘুষ না দিলে কোন ফাইল বা কোন মোটরসাইকেলের গ্রাহকের ডিজিটাল নাম্বার প্লেট এর কাজ হয় না। গ্রাহকরা প্রতিনিয়ত হয়রানির শিকার হচ্ছে । যদি কখনো মোটরসাইকেল রেজিস্ট্রেশন এর জন্য কোন ব্যক্তি ঘুষ ছাড়া কাজ করতে যায় তাহলে তাকে কাগজ পাতি তে পদে পদে ভুল ধরা হয় বা তাকে বারবার অফিসে এসে ধরনা ধরতে হয়। তারপরও সেই সকল গ্রাহককের কাজগুলো সঠিক ভাবে সমাধান হয় না।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, নতুন সড়ক পরিবহন আইনে জরিমানা ও শাস্তির বিধান বাড়ায় রেজিষ্ট্রেশন, লাইসেন্স ও ফিটনেস সনদ নিতে কুষ্টিয়া বিআরটিএ অফিসে প্রতিদিন ভীড় করছে সেবা প্রত্যাশী শতশত মানুষ। আগের তুলনায় কাজ প্রায় দুই থেকে তিনগুন বেড়েছে। আর চালকসহ যানবাহন মালিকদের সচেতন করতে নানা পদক্ষেপ নিয়েছে কুষ্টিয়া জেলা পুলিশ। কিন্তু দেশের অব্যাহত সড়ক দুর্ঘটনায় শত শত মানুষের প্রাণহানী কমাতে ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রদানে সরকারের সকল মহতি উগ্যোগ মানছে না লাইসেন্স প্রদানকারী কর্তৃপক্ষ বিআরটিএ অফিস।
কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের নিচে বিআরটিএ কার্যালয়টি অবস্থিত। ওই কার্যালয় থেকে গ্রাহকরা যানবাহন ও মোটরসাইকেল নিবন্ধন, যানবাহনের রুট পারমিট ও ড্রাইভিং লাইসেন্সের সেবা নেন। বিআরটিএ’র কর্মচারীরা দালালদের মাধ্যমে ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য ৬ হাজার থেকে ৮ হাজার আর মোটরসাইকেল নিবন্ধনের জন্য ৩ হাজার থেকে ৫ হাজার টাকা অতিরিক্ত নিচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। বিআরটিএ অফিসের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের প্রত্যেকের একাধিক দালাল ফিট করা রয়েছে। বাড়তি টাকা দিয়ে দালালদের ধরলে এক মাসের কাজ নিমিষেই চোখের পলকে হয়ে যায়। কিন্তু কোন সঠিকভাবে কাজ করতে গেলে গ্রাহককে ছয় মাস বা এক বছরও কোন গ্রাহক ঘুরতে হয় বিআরটিএ অফিসের দরজায়। সেই সকল গ্রাহকরা সঠিক কাগজপত্র দিয়ে কাজ করে আনতে পারেন না। এমন অনেক অভিযোগ রয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছক এক গ্রাহক বলেন, সরকারি ফি জমা দিয়ে নিয়ম অনুযায়ী কাগজপত্র জমা দিতেই পারিনি। যার কাছে যায় সেই দালাল। অফিসের কর্মকর্তাকেই খুজে পায়নি। পরে ব্যবহারিক, লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা দিয়ে দুই বছর যাবৎ ঘুরছি, লাইসেন্স পাচ্ছি না। অথচ পরিচিত অনেকে অতিরিক্ত টাকা দিয়ে চার থেকে পাঁচ মাসের মধ্যে লাইসেন্স পেয়েছে। এভাবে সরকারি একটি গুরুত্বপূর্ণ অফিস চলতে পারে না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছক একজন মুক্তিযোদ্ধা বলেন, কুষ্টিয়া বিআরটিএর কার্যালয় যেন হরিলুটের কারখানা খুলে বসে আছে, ঘুষ ছাড়া এই বিআরটিএর কার্যালয়ের কোন কাগজ পত্র নড়ে না, বা কোন গ্রাহক সঠিকভাবে কাজ করতে পারে না। অন্যদিকে, অবৈধ লেনদেনের বিনিময়ে এক রকম নাম মাত্র পরীক্ষায় দালালদের মাধ্যমে অদক্ষ চালকদের অবাধে দেয়া হচ্ছে ড্রাইভিং লাইসেন্স।
বিআরটিএ কার্যালয় সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রাপ্তির জন্য প্রার্থীকে প্রথমে নির্দিষ্ট ফরমে আবেদন করতে হয়। পেশাদার লাইসেন্স-এর জন্য সরকার নির্ধারিত ফি হচ্ছে ১৬৮০ টাকা আর অপেশাদার লাইসেন্সের জন্য ২৫৪২ টাকা। একজন পেশাদার ও অপেশাদার চালককে তার ড্রাইভিং লাইসেন্স পেতে হলে বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ)’র মোট ৫টি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে হয়। এর আগে চালককে তিন মাসের জন্য একটি শিক্ষানবীশ লাইসেন্স (লার্নার) প্রদান করা হয়। যার দ্বারা পরীক্ষার্থীরা উপযুক্ত শিক্ষা লাভের পর পরীক্ষা দেবে। পরীক্ষাগুলো হলো, লিখিত, মৌখিক, জিগজ্যাগ, র্যাম ও সর্বশেষ রোড টেস্ট। এসব পরীক্ষায় সাফল্যর সঙ্গে উত্তীর্ণ হওয়ার পর আরও নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার পর একজন চালককে দেয়া হয় মোটরযান চালানোর জন্য ড্রাইভিং লাইসেন্স। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে একজন চালকের হাতে ড্রাইভিং লাইসেন্স পেতে সময় লাগে ৩ মাস। কিন্তু দালাল না ধরলে লাইসেন্স পেতে প্রায় এক বছর সময় লাগে। এই সুযোগটিকে কাজে লাগিয়ে গ্রাহককে কম সময়ে লাইসেন্স দেয়ার কথা বলে ও পরীক্ষায় পাশ করিয়ে দেবার শর্তে দালালরা হাতিয়ে নিচ্ছেন লাখ লাখ টাকা। এর সবকিছুই সম্ভব হচ্ছে কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপের মাধ্যমে। আর টাকার ভাগ পেতেই সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা থাকছেন নীরব দর্শকের ভূমিকায়। বোর্ড গঠন করে দালালদের কাজ ভাগ করে দেওয়া হয় এখানে। কাগজের উপর ইংরেজি অক্ষরে দালালের সিম্বল দেওয়া থাকে। যা দেখে জমা নিয়ে নেন কর্মকর্তারা। সয়ং অফিসে বসে দালালি করলেও অফিসের কর্মকর্তারা লোকবল সংকটের কথা বলে রহস্যজনকভাবে নীরবতা পালন করছেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, অফিসের মোটরযান পরিদর্শক এর সহকারী রাকিবের ছত্রছায়ায় গড়ে উঠেছে এই দালালচক্র। অফিসের পিয়ন থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ কর্তাব্যক্তিটিও এই অনিয়মের সঙ্গে জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে একাধিক
বিশ্বস্ত সূত্র থেকে।
এ বিষয়ে রাকিবের মুঠোফোন জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি এ বিষয়ে কিছু বলতে পারবো না, আমার উপরের কর্মকর্তাদের সাথে যোগাযোগ করুন। তার বিরুদ্ধে অভিযোগের কথা তুললেও তিনি একই কথা বলেন।
পরে রাত আনুমানিক ১০ টার দিকে পত্রিকা কার্যালয়ের বিভিন্ন পর্যায়ে একাধিক মানুষকে দিয়ে সংবাদ প্রকাশ না করার জন্য অনুরোধ জানানো হয়।
উল্লেখ্য, ২০২০ সালের ১৮ জানুয়ারি কুষ্টিয়ার বিআরটিএ কার্যালয়ে দুদকের অভিযান চলে। সেবা গ্রহণকারীদের কাছ থেকে সরকারি ফির চেয়ে অতিরিক্ত অর্থ আদায় করা হচ্ছে, এমন অভিযোগ পেয়ে সেখানে অভিযান চালায় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। অভিযানে দুই দালালকে আটক করে পরে তাঁদের ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে কারাদন্ড দেওয়া হয়। কারাদণ্ডপ্রাপ্ত দুই দালাল হলেন কুষ্টিয়া শহরতলির উদিবাড়ী এলাকার মো. দুলাল (৩৯) ও শহরের পূর্ব মজমপুর এলাকার মনিরুজ্জামান (৩৫)। এমন আরো কঠোর অভিযান দাবী করেছেন ভূক্তভোগীরা।