লাইলাতুল মি’রাজ বা শবে মি’রাজ, মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য বছরের অন্যতম ফজিলতপূর্ণ রজনী । ২৬ রজব দিবাগত রাতে এই রাতেই রাসুল (সা.) আল্লাহর নৈকট্য লাভ করেন। রাসুল (সা.) জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুজিজা বা অলৌকিক ঘটনাগুলোর একটি এই লাইলাতুল মি’রাজ। তিনি মহান আল্লাহ রাব্বিল আলামীনের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য বিশেষ ব্যবস্থায় আকাশে গমন করেন। ঐতিহাসিক সেই সফরকেই মিরাজ বলা হয়। আর এই মি’রাজের মাধ্যমেই সৃষ্টির সর্ব শ্রেষ্ট মহামানব মুহাম্মাদ (সাঃ) তার উম্মত অর্থ্যাত আমাদের জন্য সুসংবাদ নিয়ে আসেন। এই মিরাজের সফর থেকেই ৫০ ওয়াক্ত নামাজ থেকে কমিয়ে রাসুল (সাঃ) তার উম্মতদের জন্য ৫ ওয়াক্ত ফরজ নামাজের সুসংবাদ উপহার আনেন। মি’রাজ আরবি শব্দ, শাব্দিক অর্থ ঊর্ধ্বগমন, আকাশপথে ভ্রমণ করা ইত্যাদি। রজব মাসের ২৬ তারিখ দিবাগত রাতে উম্মে হানির ঘর থেকে জাগ্রত অবস্থায় বোরাক নামক একটি বিশেষ বাহনে করে মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসা, সেখান থেকে প্রথম আকাশ হয়ে সপ্তাকাশ, সেখান থেকে বায়তুল মামুর, সিদরাতুল মুনতাহা, আরশে আজিম পৌঁছে আল্লাহর দিদার লাভ করেন এই মি’রাজের রাতে। ঐতিহাসিকদের মতে, ৫২ বছর বয়সে হিজরতের এক বছর আগে রজব মাসের ২৬ তারিখ দিবাগত রাতে মেরাজের ঘটনা ঘটে। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেন, ‘পবিত্র সত্তা তিনি, যিনি তার বান্দাকে তার নির্দশনগুলো দেখানোর জন্য রাতকালে ভ্রমণ করিয়েছেন মসজিদে হারাম থেকে মসজিদুল আকসা পর্যন্ত। যার পরিবেশ পবিত্র, নিশ্চয়ই তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা (বনি ইসরাইল, আয়াত-১)।
হাদিসের ভাষ্য অনুযায়ী, মি’রাজের রাতে রাসুল (সা.) উম্মে হানি বিনতে আবু তালিবের ঘরে ঘুমিয়েছিলেন। হঠাৎ হজরত জিবরাইল (আ.) এসে রাসুল (সাঃ)কে মসজিদুল হারামে নিয়ে যান। যেখানে তার বুক বিদীর্ণ করে জমজম কূপের পানি দিয়ে সিনা ধুয়ে পরিষ্কার করে শক্তিশালী করেন। তারপর সেখান থেকে তিনি ‘বোরাক’ নামক এক ঐশী বাহনে চড়ে বায়তুল মোকাদ্দাসে এসে সব নবীর ইমাম হয়ে দুই রাকাত নামাজ আদায় করেন। তারপর তিনি বোরাকে চড়ে ঊর্ধ্বে গমন করতে থাকেন। একের পর এক আসমান অতিক্রম করতে থাকেন। যাওয়ার পথে মুসা (আঃ) সহ বেশ কয়েকজন নবী-রাসুলের সঙ্গে সাক্ষাত্ হয়। সপ্তম আসমানের পর রাসুল (সাঃ)কে বায়তুল মামুর পরিদর্শন করানো হয়। বায়তুল মামুরে দৈনিক ৭০ হাজার ফেরেশতা প্রবেশ করেন। ফেরেশতাদের সংখ্যা এত বেশি যে, যারা একবার এই বায়তুল মামুরে প্রবেশ করেন কেয়ামত পর্যন্ত তাদের সেখানে প্রবেশ করার পালা আসে না। সেখানে হজরত রাসুল (সাঃ) স্বচক্ষে বেহেশত ও দোজখ দেখেন। বায়তুল মামুরে হজরত জিবরাইলকে (আ.) রেখে তিনি ‘রফরফ’ নামক আরেকটি আসমানি বাহনে চড়ে মহান আল্লাহর দরবারে হাজির হন। এখানে হজরত রাসুল (সাঃ)-এর উম্মতের ওপর ৫০ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ করা হয়। পরবর্তী সময়ে অন্তত ৯ বার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহতায়ালা দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ উম্মতে মোহাম্মদীর ওপর ফরজ করেন। আর এই সুসংবাদ নিয়েই রাসুল (সাঃ) দুনিয়াতে ফিরে আসেন। নামাজ ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের অন্যতম রুকন বা ভিত্তি। তাই রাসুল (সাঃ) এর উম্মতদের জন্য এটি ছিলো বিশেষ সুসংবাদ।
রাসুলের (সা.) মি’রাজ সম্পর্কে অসংখ্য প্রমাণাদি রয়েছে। এজন্য কোনো মুসলমানের পক্ষে তা অস্বীকার করা কিংবা এ ব্যাপারে সংশয় দেখানোর অবকাশ নেই বরং এ বিষয়ে সংশয় মূলক চিন্তা করাও হারাম। একজন মুসলমানের মেরাজের সত্যতা প্রমাণের অপেক্ষা না করে এ বিষয়ে মনে প্রাণে বিশ্বাস স্থাপন করা ঈমানি কর্তব্য। রাসুল (সা.)-এর মিরাজে যাওয়ার কথা একজন অবিশ্বাসীর মুখে শুনে হজরত আবু বকর (রা.) ততক্ষণাৎ বিশ্বাস করেছিলেন বলেই হজরত রাসুল (সাঃ) তাকে ‘সিদ্দিক’ উপাধি দিয়েছিলেন।
ইসলামের প্রধানতম স্তম্ভ¢ নামাজ ফরজ করা হয় এই রাতে। তাছাড়া ওই রাতে রাসুল (সাঃ)কে স্বচক্ষে এমন কিছু বিষয় দেখানো হয়, যা একটি আদর্শিক সমাজ গঠনে পরবর্তী জীবনে কাজে লাগে। ওই রাতে নবীদের ইমাম বানিয়ে আল্লাহতায়ালা মোহাম্মাদুর রাসুল (সাঃ)কে শ্রেষ্ঠত্বের বাস্তব উদাহরণ স্থাপন করেন। এই রাতের মাধ্যমে শুধু শ্রেষ্ঠত্ব দেয়া হয়নি, তার উম্মতদেরও শ্রেষ্ঠত্ব দেয়া হয় শবে মি’রাজের এই পবিত্র রজনীতে। এজন্য মি’রাজের শিক্ষার বাস্তব প্রতিফলন ঘটানোই একজন আদর্শ উম্মত তথা মুসলমানের কাজ। শবে মি’রাজ মুসলমানদের কাছে বিশেষ মর্যাদার। ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা নফল ইবাদত বন্দেগির মধ্যে দিয়ে এই মূল্যবান রাত অতিবাহিত করেন। অনেকে নফল রোজা রাখেন এ দিন। মহান আল্লাহ আমাদের ফজিলতপূর্ণ এ রজনী ইবাদত বন্দেগীর মাধ্যমে কাটানোর তৌফিক দান করুন। আমিন।
লেখক-কামিল (আল হাদিস) মাস্টার্স (ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ) ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়।-সঁহরনশংঃ@মসধরষ.পড়স