কুষ্টিয়ায় ওঝা-কবিরাজের অপচিকিৎসা ও ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসাপতালে বিষধর সাপের কামড়ে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের মৃত্যুহার শতভাগে দাঁড়িয়েছে। হাসপাতাল সূত্র জানায়, ২০২০ জানুয়ারী থেকে ২০২১ সালের ১৫ অক্টোবর পর্যন্ত সময় কালে কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে সাপের কামড়ে আহত হয়ে আগত ৩২জন রোগীর সবাই মৃত্যু বরণ করেছেন। যদিও বিষধর সাপের কামড়ে আহত মোট রোগীর প্রতি ৪ জনের মধ্যে একজন রোগী হাসপাতাল পর্যন্ত পৌছাতে সক্ষম হন বলে কুষ্টিয়া সিভিল সার্জন কার্যালয়ের একটি নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা যায়। জীবিত অবস্থায় হাসপাতাল পর্যন্ত পৌছেও চিকিৎসকদের অবহেলায় সময়মত এন্টি স্নেক-ভেনাম প্রয়োগ করতে না পারায় এসব রোগী মৃত্যুর কারণ বলে অভিযোগ ভুক্তভোগী পরিবারের। অন্যদিকে প্রত্যন্ত অঞ্চলের বাসিন্দা ও সুবিধা বঞ্চিত এসব প্রান্তিক জনগোষ্ঠী সচেতনতার অভাবে সাপের কামড়ে আহত রোগীর বিষ ধ্বংসে ওঝা কবিরাজের কাছে গিয়ে সময় ক্ষেপনের কারণই এসব রোগী মৃত্যুর অন্যতম কারণ বলে দাবি হাসপাতালের সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকদের। বিষধর সাপের কামড়ে আহত রোগীদের বাঁচাতে প্রয়োগযোগ্য চিকিৎসার সময় পাওয়া যায় খুব কম। সেকারণে উপজেলা পর্যায়ের প্রত্যন্ত অঞ্চলে সাপের কামড়ে আহত রোগীর জরুরী চিকিৎসায় প্রতিটি উপজেলা স্বাস্থ্য কম্পেøক্সে এন্টি স্নেক-ভেনাম সংরক্ষনের দাবি জেলাবাসীর।
দৌলতপুর উপজেলার দক্ষিণ দাড়েরপাড়া গ্রামের বাসিন্দা জালাল উদ্দিনের ৭ম শ্রেনীতে পড়ুয়া কন্যা এবং স্থানীয় ডিজিএম মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী সোনিয়া খাতুন ০১অক্টোবর, ২০২১ রাতের খাবার খেয়ে নানীর সাথে ঘুমিয়ে ছিলেন। ঘুমন্ত অবস্থায় তাকে সাপে কামড় দেয়। যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকলে তাকে দ্রুত উদ্ধার করে কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যায় পরিবারের লোকজন। সেখানে ভর্তি হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাত দুইটার দিকে সোনিয়ার মৃত্যু হয়। ওই ছাত্রীর পিতা জালাল উদ্দিনে অভিযোগ, হাসপাতালে ভর্তির পর প্রায় পৌনে দুইঘন্টা মেয়েটা বেঁচে ছিলো, কিন্তু এসময়ের মধ্যেও সোনিয়াকে এন্টি ভেনাম দেয়নি ডাক্তার।
গত ০৬ অক্টোবর, ঝিনাইদহের হরিনাকুন্ডু উপজেলার তাহেরহুদা গ্রামের বাসিন্দা বকুল হোসেন(৩৫)কে দুপুর সাড়ে ১২টায় হলুদ ক্ষেত থেকে বিষধর সাপে কামড় দেয়। পরিবারের লোকজন তাকে উদ্ধার করে ২জন ওঝা ডেকে আনেন বাড়িতে। সেখানে প্রায় দুই ঘন্টাধিকাল ধরে বিষ ধ্বংসের চেষ্টা চালায় ওঝাদ্বয়। পরে অবস্থার অবনতি হওয়ায় পরিবারের লোকজন বেলা ৩টার দিকে আহত বকুলকে কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে আসেন। হাসপাতালে ভর্তির পর এন্টি স্নেক-ভেনাম প্রয়োগের পূর্বে ঘণ্টা খানেকের মধ্যেই বকুলের মৃত্যু হয় বলে হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়। ওই রোগীর সাথে আসা প্রতিবেশী শহিদুল্লাহর অভিযোগ, ‘ একদিকে ঠকবাজ ওঝাদের খপ্পরে পড়ে বকুলের জীবন যায় যায়, অন্যদিকে সাত সমুদ্র তের নদী পার হয়ে এতো ঝক্কিঝামেলা শেষে রোগীটি হাসপাতাল পর্যন্ত এসে ভর্তি হওয়ার পরও বাঁচাতে পারলাম না’। এটা খুব দু:খজনক।
সদর উপজেলার হাটশ হরিপুর গ্রামের সিরাজ সাপুড়ে বলেন, ‘দ্যাকেন, আপানারা একন যেদি ব্যাবুজের মতো সাপে কামড় দিলিই ওঝার কাচে দইড়ি যান, তালি ওঝার কি করার আচে ? ধরেন যে, সত্যিই যেদি কুলিম(গোখরা) সাপে কামড়ায় আর বিষ যেদি রক্তর সাতে মিশি যায়, তালি কোন শালার উজার বাপের ক্ষ্যামতা নি যে ওই রুগীক বাঁচাতি পারে’। সেজন্যি ভাই আপনারা শোনেন, বিষধর সাপে কাটলি কোন দিক তাকাবেন না, সুজা হাসপাতালে চইলি যাবেন। বাঁচানির মালিক আল্লাহ।
২৫০শয্যা বিশিষ্ট কুষ্টিয়া জেনারেল হ্সাপতালের ভারপ্রাপ্ত আবাসিক চিকিৎসক ডা: আশরাফুল আলম জানান, সাপের কামড়ে আহত কয়টা রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে বা কয়টা রোগী চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ্য হয়েছে সেবিষয়ে সঠিক তথ্য এমুহুর্তে আমার কাছে নেই।
তত্ত্বাবধায়ক ডা: মো: আব্দুল মোমেন বলেন,“এমুহুর্তে এবিষয়ে কিছুই জানিনা, এতোবড়ো হাসপাতালে কে বা কারা কয়জন সাপের কামড়ে আহত হয়ে ভর্তি হয়েছে তা খোঁজ নিয়ে বলতে পারব” কথাটি বলেই ফোন কেটে দেন পরে কল রিসিভের অনুরোধ করে খুদে বার্তা পাঠিয়ে একাধিকবার কল করলেও তিনি কল রিসিভ করেন নি।
কুষ্টিয়া সিভিল সার্জন ডা: এইচ এম আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, বিধি মতে হাসপাতালে রোগী ভর্তি, চিকিৎসা ও মৃত্যু সংক্রান্ত সকল বিষয় অবশ্যই ঘটনার সময়ই তাৎক্ষনিক ভাবে আবাসিক মেডিকেল অফিসারের জানার কথা। তিনি কেন এমনটি বললেন তা আমার বোধগম্য নয়। এখন পর্যন্ত স্বাস্থ্য বিভাগের সিদ্ধান্ত মতে, প্রতিটা জেলা সদর হাসপাতালে এন্টি ভেনাম ভ্যাক্সিন সংরক্ষন করা হয়। শুধুমাত্র বিষধর সাপের কামড়ে আহত রোগীদের চিকিৎসায় বিনামূল্যে দেয়া হয়।